শিক্ষার বিভিন্ন দিকের উপর মনোবিজ্ঞানের প্রভাব | Influence of Psychology on Different Aspects of Education
শিক্ষার বিভিন্ন দিকের উপর মনোবিজ্ঞানের প্রভাব | Influence of Psychology on Different Aspects of Education
1. শিক্ষার লক্ষ্য ও মনোবিজ্ঞান (Aims of Education and Psychology):
মনোবিজ্ঞান মানুষের মন বা আচরণ অনুশীলন করে তার সাধারণ নিয়মাবলি নির্ধারণ করে। শিক্ষাবিজ্ঞান শিক্ষাক্ষেত্রে শিশু, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী বা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তির মানসিক বিকাশসাধনের জন্য মনোবিজ্ঞানের এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে থাকে। শিক্ষার লক্ষ্য—'ব্যক্তিমনের বিকাশসাধন করা' তা মনোবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্যের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। সুতরাং, শিক্ষাবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান।
2. আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞান (Modern Child-centric Education and Psychology):
আধুনিক শিক্ষার মূল কথা হল—“শিশুর জন্য শিক্ষা, শিক্ষার জন্য শিশু নয়'। আধুনিক এই শিক্ষাকে বলা হয় শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা (Child-centric Education)। এই শিক্ষার তাৎপর্য হল—শিক্ষার্থীর চাহিদা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আগ্রহ, প্রবণতা ইত্যাদি সব দিক বিবেচনা করে তাকে শিক্ষা দিতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষা দেওয়ার পূর্বে শিক্ষার্থীকে ভালোভাবে জানতে হবে। শিক্ষার্থীকে ভালো করে জানার অর্থ হল তাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে অনুশীলন করা। একমাত্র মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানই পারে কোনো মানুষকে বৈজ্ঞানিকভাবে অনুশীলন করতে। এই বিষয়ে মনোবিজ্ঞানের শাখা শিশু মনোবিজ্ঞান (Child Psychology) যথেষ্ট সাহায্য করে থাকে। সুতরাং, শিক্ষার আধুনিক ভাবধারা-শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে শিক্ষাবিজ্ঞানের সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করেছে।
3. আধুনিক শিক্ষালয়ের ধারণা ও মনোবিদ্যা (Concept of Modern Educational Institutions and Psychology):
মনোবিজ্ঞানে বলা হয়েছে, শিশুর আচরণ পরিবর্তনের জন্য স্বাভাবিক সামাজিক পরিবেশ প্রয়োজন । মনোবিজ্ঞানের এই পরীক্ষিত সিদ্ধান্তের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আধুনিক শিক্ষার শিক্ষালয়সংক্রান্ত ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। আধুনিক ধারণা অনুযায়ী প্রত্যেকটি শিক্ষালয় এমন হবে যেন তা সামাজিক পরিবেশে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তার শিক্ষা প্রচেষ্টাকে সার্থক করতে পারে। শিক্ষালয় সংক্রান্ত এই ধারণা সমাজ মনোবিদ্যার (Social Psychology) ধারণার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে।
4. সক্রিয়তার নীতি ও মনোবিদ্যা (Activity Principle and Psychology):
মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই সক্রিয়তাপ্রবণ। অর্থাৎ প্রায় প্রতিটি শিশুই চঞ্চল প্রকৃতির। সে কিছু না কিছু করতে চায়। তার এই কিছু করার মধ্যেই সে শিক্ষা তথা অভিজ্ঞতা লাভ করে। শিশুর এই সক্রিয়তার মধ্য দিয়েই তার আচরণগত প্রবণতাগুলির পরিবর্তন ঘটে। সেগুলিকে প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষার কাজে ব্যবহার করতে পারলে শিশুর কাছে শিক্ষা আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। আধুনিক শিক্ষার একটি মূলনীতি হল সক্রিয়তার নীতি ( Activity Principle)। অর্থাৎ প্রত্যেক শিক্ষার্থী তার আত্ম-সক্রিয়তার মাধ্যমেই শিখবে। আধুনিক শিক্ষার এই সক্রিয়তার নীতি মনোবিজ্ঞানের তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত।
5. শিক্ষণ পদ্ধতি ও মনোবিজ্ঞান (Methods of Teaching and Psychology):
আধুনিক শিক্ষায় ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলির প্রত্যেকটিই মনোবৈজ্ঞানিক নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতিতে মনোবিজ্ঞানের যে বৈশিষ্ট্যগুলি প্রয়োগ করা হয় সেগুলি হল—
• জ্ঞানের সামগ্রীকে বহু ইন্দ্রিয়ভিত্তিক উদ্দীপনার (Multisensory stimulation) মাধ্যমে উপস্থাপন করা।
শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুর বিভিন্ন অংশকে নির্দিষ্ট ধারাবাহিক ক্রম (Serial Order) অনুযায়ী উপস্থাপন করা।
পাঠগ্রহণের সময় শিক্ষার্থীকে দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে সক্রিয় করে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্দেশ্যমুখী কর্ম নির্বাচন করা।
6. পাঠক্রম রচনা ও মনোবিজ্ঞান (Curriculum Construction and Psychology):
মনোবিজ্ঞানে বলা হয়েছে, শিশুকে বহুমুখী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করতে পারলে তার সামগ্রিক মানসিক বিকাশ ঘটে। মনোবিজ্ঞানের এই সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে আধুনিক শিক্ষার পাঠক্রম রচনা করা হয় এবং পাঠক্রমে শিক্ষার্থীর জীবন বিকাশের উপযোগী প্রয়োজনীয় সকল রকম অভিজ্ঞতাকে অন্তর্ভুক্ত করে সেটিকে বহুমুখী করে তোলা হয়।
7. সময়তালিকা ও মনোবিজ্ঞান (Time Table and Psychology):
কাজ ও অবসাদ (Work and Fatigue) সংক্রান্ত মূল মনোবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে আধুনিক শিক্ষালয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য সময়তালিকা স্থির করা হয়। এই নীতি অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত জটিল বিষয়গুলি দিনের প্রথম অংশে অথবা বিরতির ঠিক পরেই রাখা হয়। একটানা অনেকক্ষণ সময়ের জন্য বিরতি না দিয়ে মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্য বিরতি দেওয়া হয়।
৪. শৃঙ্খলা ও মনোবিদ্যা (Discipline and Psychology):
মনোবিজ্ঞানে বলা হয়েছে, অন্তর্জাত শৃঙ্খলা স্থাপিত হলে, তার মাধ্যমে যে আচরণ ধারার পরিবর্তন ঘটে, সেই পরিবর্তনগুলি স্থায়ী হয় এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে ব্যক্তির মধ্যে থাকে। অন্যদিকে, বহির্জাত শৃঙ্খলার মাধ্যমে যে আচরণগুলি নিয়ন্ত্রিত হয়, সেগুলি অস্থায়ী ও পরিবর্তনশীল। অনুশাসন বা চাপের অভাব ঘটলে, সেই আচরণগুলি আবার ব্যক্তির মধ্যে প্রকাশ পায়। আধুনিক শিক্ষায়, শিক্ষার্থীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে শৃঙ্খলা স্থাপনের যে মুক্ত শৃঙ্খলা ( Free Discipline) নীতিগ্রহণ করা হয়েছে, তা এই মনোবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের উপর প্রতিষ্ঠিত।
9. ব্যক্তিগত বৈষম্য ও মনোবিজ্ঞান (Individual Difference and Psychology):
প্রাকৃতিক নিয়মে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এই পার্থক্য দৈহিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক, বৌদ্ধিক ইত্যাদি নানা দিক থেকে হতে পারে। এই পার্থক্যকে ভিত্তি করে আধুনিক শিক্ষার বিভিন্ন দিকগুলি বিবেচনা করা হয়। ব্যক্তিগত বৈষম্য কী, এই বৈষম্য কোন্ কোন্ দিক থেকে আসে, এই বৈষম্যকে ভিত্তি করে কীভাবে শিক্ষা পরিকল্পিত হবে ইত্যাদি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য মনোবিজ্ঞানই সরবরাহ করে।
10. শিক্ষার উপর প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন উপাদানের পরিমাপ ও মনোবিজ্ঞান (Measures of different factors influencing on Education and Psychology):
মনোবিজ্ঞানের গবেষণা থেকে শিক্ষার উপর প্রভাব বিস্তারকারী বিভিন্ন উপাদান যেমন — বুদ্ধি ( Intelligence), আগ্রহ (Interest), মনোযোগ (Attention), মনোভাব (Attitude), ব্যক্তিত্ব (Personality), সৃজনশীলতা (Creativity) ইত্যাদি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে নানা কারণেই এই চলকগুলির পরিমাপের প্রয়োজন হয়। মনোবিজ্ঞানে এই জাতীয় চলকগুলি পরিমাপের বহু নির্ভরযোগ্য আদর্শায়িত অভীক্ষা প্রস্তুত করা হয়েছে।
11. শিক্ষকের ভূমিকা ও মনোবিজ্ঞান (Role of Teacher and Psychology):
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকার যে পরিবর্তন ঘটেছে, তাও মনোবিজ্ঞানভিত্তিক। প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষক ছিলেন ঈশ্বরের সমতুল্য, শ্রদ্ধার ও ভয়ের পাত্র। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক হলেন বন্ধু, পরামর্শদাতা ও নির্দেশক (Friend, Philosopher and Guide)। শিক্ষক সম্পর্কিত এই আধুনিক ধারণা সম্পূর্ণ মনোবিজ্ঞানসম্মত ।
12. শিক্ষামূলক ও বৃত্তিমূলক নির্দেশনা ও মনোবিজ্ঞান (Educational and Vocational Guidance and Psychology):
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষামূলক ও বৃত্তিমূলক নির্দেশনা দান করা হয়। মনোবিজ্ঞানের এই তথ্যের সাহায্যে শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শিক্ষামূলক নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে সে কোন্ বৃত্তিতে নিযুক্ত হবে সেই সংক্রান্ত নির্দেশনাও দিয়ে থাকেন।
13. মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোবিজ্ঞান (Mental Health and Psychology):
শিক্ষার কাজ সঠিকভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্য প্রয়োজন। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে বিখ্যাত মনোবিদ ও মনোচিকিৎসক ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব (Psycho-analysis Theory) অনুযায়ী অবচেতন মনের ক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে শিশুর অস্বাভাবিক আচরণের মূলে আছে অবচেতন মনের ক্রিয়া। ছোটোখাটো কামনা-বাসনার তৃপ্তি না ঘটলে সেগুলি অবচেতন মনে অবদমিত হয়ে নানা প্রকার মনোবিকারের সৃষ্টি করে। মনোবিজ্ঞানের এই জ্ঞান আধুনিক শিক্ষককে শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করে।
14. অপসংগতিমূলক আচরণ ও মনোবিজ্ঞান (Maladjust Behaviour and Psychology):
যেসব শিশু পরিবেশের সঙ্গে সার্থকভাবে অভিযোজন করতে পারে না তাদের মধ্যে নানাপ্রকার অপসংগতিমূলক আচরণ দেখা যায়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার ফলে অপসংগতির কারণ ও তা কীভাবে দূর করা যায় সেই সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের এই জ্ঞান শিক্ষককে শিক্ষার্থীর অপসংগতি দূরীকরণে সাহায্য করে।