১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্স ও ইউরোপে রাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের সংঘাত কী রূপ পেয়েছিল? February Revolution
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের (February Revolution) মাধ্যমে ফ্রান্স ও ইউরোপে রাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের সংঘাত কী রূপ পেয়েছিল?
উত্তর : ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব : ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্স বিপ্লবের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল। ইউরোপে প্রায় সর্বত্র শর হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের অভ্যুত্থান। ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ও প্রজাতন্ত্রের জয় সুচিত হয়। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত হয় এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন রাষ্ট্রপতি লুই নেপোলিয়ন (Louis Napoleon), যিনি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন।
ইউরোপে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব : ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (February Revolution) ফ্রান্সে শুরু হলেও তা কেবলমাত্র ফ্রান্সেই সীমাবদ্ধ ছিল না ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইটালি, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়।
অস্ট্রিয়া: ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে অস্ট্রিয়ায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় মেটারনিখের বাসভবন আক্রান্ত হয়। মেটারনিখ অস্ট্রিয়া ছেড়ে পালিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে আশ্রয় নেন। এর ফলে ইউরোপে মেটারনিখতন্ত্রের অবসান ঘটে। অস্ট্রিয়ার সম্রাট উদারনৈতিক সংবিধান মেনে নিতে বাধ্য হন।
হাঙ্গেরি : হাঙ্গেরি ছিল অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যভুক্ত। ফ্রান্সের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে অস্ট্রিয়াতে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ শুরু হয়। হাঙ্গেরির অধিবাসীরা লুই কসুখের (Louis Kossuth) নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই আন্দোলনের ফলে হাঙ্গেরির স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বীকৃত হয়। লুই কসুথ-কে 'হাঙ্গেরির ম্যাৎসিনি' (Mazzini of Hungery) বলা হয় ৷
জার্মানি : ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে জার্মান রাজ্য প্রাশিয়া, স্যাক্সনি, হ্যানোভার, ব্যাভেরিয়া, ব্যাডেন, ব্রান্সউইক প্রভৃতি রাজ্যে উদারনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়। এইসব রাজ্যের রাজারা উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র মেনে নিতে বাধ্য হন। জার্মান জাতীয়তাবাদীরা ফ্রাঙ্কফোর্ট শহরে সমবেত হয়ে ঐক্যবন্ধ জার্মানির জন্য একটি পার্লামেন্ট ও সংবিধান রচনা করেন। এই পার্লামেন্ট 'ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট' (Frankfurt Parliament) নামে পরিচিত।
প্রাশিয়ার রাজা চতুর্থ ফ্রেডরিক উইলিয়মকে (Frederick William IV ) ঐক্যবদ্ধ জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধানের পদ গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। কিন্তু চতুর্থ ফ্রেডরিক উইলিয়ম ছিলেন স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ও রাজার দৈবসত্তার অধিকারে বিশ্বাসী। তাই তিনি জাতীয়তাবাদীদের দেওয়া ক্ষমতা নিতে অস্বীকার করেন। ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট সফল না হলেও তা জার্মানির ঐক্য আন্দোলনের পথকে প্রশস্ত করেছিল।
ইটালি : ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে ইটালির ভেনিস, টাসকানি, পার্মা, মডেনা, মিলান, নেপলস, সিসিলি এবং পোপের রাজ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিপ্লবের ফলে লম্বার্ডি, ভেনেসিয়া, মিলান প্রভৃতি রাজ্য থেকে অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনী বিতাড়িত হয়। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার রাজা চার্লস অ্যালবার্ট (Charles Albert) নিজের রাজ্যে উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করেন। ভেনিসে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপ্লবী জোসেফ ম্যাৎসিনির (Giuseppe Mazzini) নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় রোমেও।
ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রে প্রভাব : ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে ডেনমার্ক, সুইডেন, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। ইংল্যান্ডেও এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে।
মূল্যায়ন : তবে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের বিশেষ গুরুত্ব থাকলেও এর সাফল্য ছিল সীমিত। প্রাথমিক আন্দোলনের ধাক্কা কাটিয়ে অস্ট্রিয়া প্রতি-আক্রমণ শুরু করে। ফলে ইটালি, জার্মানি, অস্ট্রিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভেঙে পড়ে। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ইউরোপের ইতিহাসের দিক পরিবর্তন করে।