ভারতে সবুজ বিপ্লব [GREEN REVOLUTION] : সংজ্ঞা, সময়,উদ্যোক্তা, গৃহীত পদক্ষেপ, প্রভাবিত অঞ্চল,ফসল
''সবুজ বিপ্লব" ভূমিকা [Introduction] : ভারতে স্বাধীনতার পর ব্যাপক খাদ্যশস্যের চাহিদার সৃষ্টি হয়। সনাতন [প্রাচীন] প্রথায় চাষ আবাদ করার ফলে ফসলের উৎপাদনের পরিমাণ ও ফলনের পরিমাণ ছিল অত্যন্ত কম। তার উপর ভারতের বিশাল জনসংখ্যা এবং খাদ্যশস্যের প্রবল চাহিদা। ভারতীয় কৃষি মহলকে প্রভাবিত করে। ফলে স্বাধীনোত্তর ভারতে ষাটের দশকে কৃষিক্ষেত্রে যেসব নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় তার প্রভাবে ফসল উৎপাদনে যে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে তাকে সবুজ বিপ্লব আখ্যা দেওয়া হয়। কৃষিক্ষেত্রে সবুজের সমারোহ ঘটে বলে ‘সবুজ বিপ্লব' কথাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ভারতে সবুজ বিপ্লব
ভারতে সবুজ বিপ্লব [GREEN REVOLUTION] : সংজ্ঞা, সময়,উদ্যোক্তা, গৃহীত পদক্ষেপ, প্রভাবিত অঞ্চল,ফসল
সংজ্ঞা [Definition] : স্বাধীনতার পর ষাটের দশকে ভারতের কয়েকটি রাজ্যের বেশ কিছু জেলায় নিবিড় কৃষি জেলা কর্মসূচি [Intensive Agricultural District Programme বা IADP] মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে নতুন উন্নত প্রযুক্তি এবং উচ্চ ফলনশীল বীজে [High yielding varieties seeds] ব্যবহার করার ফলে ফসল উৎপাদনে বিশেষ করে ধান ও গম উৎপাদনে অভূতপূর্ব উন্নতি ও ব্যাপক পরিমাণে ফসল উৎপাদিত হয়। কৃষিক্ষেত্রে এই দ্রুত এবং বিপ্লবাত্মক উন্নতিকেই সবুজ বিপ্লব বা গ্রিন রিভোলিউশান [Green Revolution] বলা হয়ে থাকে। বস্তুত গম উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ফলিভূত হয় বলে, অনেকে সবুজ বিপ্লবকে ‘গম বিপ্লব' বা হুইট রিভোলিউশান [Wheat Revolution] আখ্যা দেন। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের অনেক জেলায় ধান চাষেও ব্যাপক সাড়া মেলে।
উদ্যোগ [Step/Measures] : ষাটের দশকে ভারত সরকার আমন্ত্রিত ফোর্ড ফাউন্ডেশন'-এর একদল কৃষি বিজ্ঞানী ‘India's Food Crisis and Steps to Meet It' নামে 1959 সালে এপ্রিল মাসে ভারতে খাদ্যশস্যের ঘাটতির কারণ এবং তা মোকাবিলার উপায় বিষয়ক একটি রিপোর্ট জমা দেন। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে 1960 সালে ভারতের খাদ্যশস্যে চাহিদা মেটানোর জন্য কৃষিক্ষেত্রের উন্নতির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। হয়।
সময় [Time] : দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অর্থাৎ 1956 – 1961 সালের শেষের দিকে সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি নেওয়া
উদ্যোক্তা [Initiators] : 1963 সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশন-এর প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী ড. নরম্যান বোরলগ [Norman Borlaug]-এর নেতৃত্বে এবং ভারতীয় কৃষি বিজ্ঞানী এম.এস. স্বামীনাথন ও অন্যান্য সহকারীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ভারতে এই সবুজ বিপ্লব সাফল্য লাভ করে। নরম্যান বোরলগকে সবুজ বিপ্লবের জনক বলা হয়। তিনি গমের উন্নত বীজ সোনার-64 ও লারমা রোজো তৈরি করেন। ড. এম. এস. স্বামীনাথনকে ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক বলা হয়। তিনি গমের উন্নত বীজ শরবতি [Sharbati] এবং সোনোরা [Sonora] বীজের উদ্ভাবন করেন।
গৃহীত পদক্ষেপ [Measures undertaken] : সবুজ বিপ্লবের সার্থক রূপায়নের উদ্দেশ্যে উন্নত ধরনের সংকর জাতের বীজ [HYV seeds], জলসেচের প্রসার, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দ্রব্যের ব্যবহার এবং কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যাপক ব্যবহারের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। লারমা রোজো-644 [Lerma Roja-644], সোনারা-64 [Sonara-64], কল্যাণ সোনা [Kalyan Sona] প্রভৃতি উচ্চ ফলনশীল গমের বীজ এবং আই.আর-8 [IR-8], জয়া [Jaya], পদ্মা [Padma] প্রভৃতি ধানের হাইব্রীড বীজ ভারতের কৃষিতে বিপ্লব বা সাফল্য ঘটাতে ব্যবহার করা হয়।
প্রভাবিত অঞ্চল [Influenced Area ] : 1960 সালে অন্ধ্রপ্রদেশের পশ্চিম গোদাবরী, বিহারের শাহাবাদ, ছত্তিশগড়ের রায়পুর, তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুর, পাঞ্জাবের লুধিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের আলিগড় এবং রাজস্থানের পালি জেলায় সবুজ বিপ্লবের উদ্যোগ হিসাবে নিবিড় কৃষি জেলা কর্মসূচি [IADP] গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী কালে এই সাফল্য ভারতের আরো অনেক জেলায় প্রসার লাভ করে। প্রথমদিকে ভারতের মোট 39 টি জেলায় এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং পরে তা ভারতের অনেক জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।
ফসল [Crops] : প্রথমে গম ও ধান উৎপাদন দিয়ে শুরু হলেও পরে তৈলবীজও অন্যান্য ফসলেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি সবজি ও ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এর ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তৈলবীজের উৎপাদন বৃদ্ধিকে হলুদ বিপ্লব বা ইয়েলো রিভোলিউশন | Yellow Revolution] বলা হয়ে থাকে।
সবুজ বিপ্লবের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার: সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো হয়েছিল।
উচ্চ ফলনশীল (HYV) বীজের ব্যবহার: এই বীজগুলির ফলন অন্যান্য বীজের তুলনায় অনেক বেশি ছিল।
সেচ ব্যবস্থার উন্নতি: জলের সঠিক ব্যবহারের জন্য সেচ ব্যবস্থা উন্নত করা হয়েছিল।
সবুজ বিপ্লবের কিছু সুবিধা:
- খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে সহায়ক ছিল।
- কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল।
- খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিল।
সবুজ বিপ্লবের কিছু নেতিবাচক প্রভাবও ছিল:
- রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে পরিবেশ দূষণ হতে পারে।
- মাটির উর্বরতা হ্রাস হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, অল্প সংখ্যক ফসলের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণে শস্যের বৈচিত্র্য হ্রাস হতে পারে।
- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই বিপ্লব কম কার্যকর হতে পারে।