একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিজ্ঞানী প্রবন্ধ রচনা | অষ্টম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনা | একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি প্রবন্ধ রচনা
প্রবন্ধ রচনা: একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিজ্ঞানী প্রবন্ধ রচনা | অষ্টম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনা | একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিজ্ঞানী রচনা
প্রাক্কথন: বাঙালি-মনীষা হীরক দীপ্তির মতো শতধারায় বিচ্ছুরিত। সুদুর প্রাচীনকাল থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বহু বাঙালি বৈজ্ঞানিক মণীষার আবির্ভাব ঘটেছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মনীষার সঙ্গে মানবপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধের বিরল সমন্বয় ঘটেছিল যে মহান ব্যক্তিত্বের তাঁর নাম আচার্য প্রফুলচন্দ্র রায়। আজ এই মহান ব্যক্তিত্বের সার্ধ শতবর্ষ জন্মজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন জ্ঞানতাপস। আদর্শবাদী এই বিজ্ঞানী সরল অনাড়ম্বর জীবন নির্বাহ করে এক অত্যুজ্জ্বল আদর্শবাদী আচার্যের ভূমিকা পালন করে গেছেন।
জন্মবৃত্তান্ত ও বংশপরিচয় : বিজ্ঞানসাধক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বাংলাদেশের যশোহর জেলায় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ২রা আগষ্ট জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম হরিশ্চন্দ্র রায় ও মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। তাঁর পিতা হরিশ্চন্দ্র ছিলেন উদার দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। তিনি ছিলেন রামমোহন রায়ের সমসাময়িক। তাঁদের বাড়িতে প্রায় দিনই গানের জলসা বসত। অর্থাৎ অধ্যয়নের পাশাপাশি তাঁর পিতা সঙ্গীতরসিকও ছিলেন। এই পরিবেশে মানুষ হবার ফলে প্রফুল্লচন্দ্রের মধ্যেও স্বাভাবিকভাবেই পিতৃচরিত্রের নানা প্রভাব পড়েছে।
শিক্ষা : মাত্র চার বছর বয়সে গ্রামের পাঠশালায় তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। গ্রাম্য পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে অ্যালবার্ট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে মেট্রোপলিটন ও প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যায়ন করেন। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন এবং বিলাত যাত্রা করেন। সেখানে তিনি অত্যন্ত মেধার সঙ্গে লড়াই করে বি.এস.সি. পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর নিজের গবেষণার জন্য এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.এস.সি. উপাধি লাভ করেন।
ছাত্রদরদি অধ্যাপক রূপে প্রফুল্লচন্দ্র : প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিলেত থেকে রসায়নশাস্ত্রে কৃতবিদ্য হয়ে দেশে ফিরে প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক রূপে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে এই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করে বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি ছাত্রদের কেবলমাত্র শিক্ষাদান করেই বিরত থাকতেন না, তাদেরকে গবেষণার কাজেও উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর হাতে গড়া বহু কৃতি ছাত্র পরবর্তীকালে যোগ্য উত্তরসাধকরূপে চিহ্নিত হয়েছিলেন। নীলরতন সরকার, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, পুলিনবিহারী সরকার, হেমচন্দ্র সেন প্রমুখ ছাত্র তাঁরই শিক্ষাধারায় স্বনামধন্য হয়ে উঠেছেন। দরিদ্র ছাত্রদের প্রতিও তিনি যথেষ্ট উদার মনোভাবাপন্ন ছিলেন।
প্রতিষ্ঠাতা ও গবেষকরূপে প্রফুল্লচন্দ্র : আচার্য রায় এবং তাঁর ছাত্রদের উদ্যোগে ১৯০১ সালে ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম রাসায়নিক দ্রব্যও ওষুধ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। জগদীশচন্দ্র সমসাময়িক এই
বিজ্ঞানী ‘ভারতীয় রসায়নশাস্ত্রের জনক' রূপে পরিচিত। ‘মারকিউরাস নাইট্রাট' আবিষ্কার করে বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলে তিনি সমাদর লাভ করেন। বাঙালি তথা দেশের তরুণসমাজ ব্যবসায়ে, শিল্প উৎপাদনে,
বিজ্ঞানচর্চায় কীভাবে স্বনির্ভর হয়ে উঠুক এই ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষা । বিজ্ঞানকে শিল্পোদ্যোগে পরিবর্তিত করা গেলে সুরাহা সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন। ১৮৯৩ সালে সামান্য কিছু মূলধন নিয়ে আপার সার্কুলার রোডে ‘Bengal Chemical and Pharmaceautical Works', নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যা ভারতবর্ষের প্রথম পদক্ষেপ বলে বিবেচনা করা হয়। বেঙ্গল কেমিক্যাল ছাড়াও প্রফুল্লচন্দ্ৰ আরও অনেকগুলি দেশীয় শিল্প প্রবর্তনের পশ্চাতে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এ বিষয়ে বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস, কলিকাতা পটারী ওয়ার্কস লিমিটেড প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
শেষকথা : বাঙালির বিজ্ঞানসাধনার গৌরবময় ঐতিহ্যকে বহন করতে হলে প্রয়োজন আত্মত্যাগ, সাধনার একনিষ্ঠতা ও দেশপ্রেম। এ জাতীয় মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে পারলে বিজ্ঞানসাধনায় এ যুগের তরুণ বিজ্ঞানীরাও আচার্য রায়ের মতো মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন। পৃথিবীর প্রতিভাবান মহাপুরুষ যেমন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকেন, তেমনি প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর মহৎ কাজের মধ্যে দিয়ে বাঙালির মনে তথা বিশ্ববাসীর হৃদয়ে চিরকাল জাগ্রত থাকবেন।