আধুনিক জীবনে বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার | বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার প্রবন্ধ রচনা | অষ্টম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনা
প্রবন্ধ রচনা: আধুনিক জীবনে বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার | বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার প্রবন্ধ রচনা | অষ্টম শ্রেণী প্রবন্ধ রচনা
আধুনিক জীবনে বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার
প্রাক্কথন : প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ কতকগুলি অতিপ্রাকৃত ও অপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাসী। এই বিশ্বাস যুক্তি-তর্ক নির্ভর নয়। নিতান্তই মানুষের অজ্ঞতার পরিচয়, মানুষ দীর্ঘদিন কোন বিশ্বাসকে মনের মধ্যে লালন করতে থাকলে এক সময় সেই বিশ্বাস পরিণত হয় সংস্কারে। সংস্কার যখন প্রগতিশীল, বিরোধী রূপে চিহ্নিত হয়, তখন তাকে বলে কুসংস্কার। সুতরাং যে সমস্ত প্রথা, আচার-আচরণ, বিশ্বাস-সংস্কার মানুষকে যুক্তিহীন অস্বাভাবিক ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত থাকতে উৎসাহিত করে, তাদেরকে কুসংস্কারের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয়।
বিজ্ঞান ও কুসংস্কারের পার্থক্য : আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানমঞ্চ সারা দেশে প্রচারাভিযান চালাচ্ছে মানুষ কীভাবে সংস্কার মুক্ত হতে পারে। কিন্তু সংস্কার মুক্ত হতে চাইলে প্রথম যার প্রয়োজন, তা হল সার্বজনীন শিক্ষার বিস্তৃতি। কারণ সুশিক্ষা মানুষকে __আত্মনির্ভরশীল করে। আত্মনির্ভর মানুষ যেহেতু পরনির্ভরশীলতায় ভর করে পা হাঁটে না, সুতরাং তার পক্ষে মাদুলি-কবচ ধারণ করা
নিষ্প্রোজনীয়। বিজ্ঞান মানুষকে মুক্ত করে, পরক্ষণেই কুসংস্কার মানুষকে বন্দি করে। তাই বিজ্ঞানের সঙ্গে কুসংস্কারের পার্থক্য অনেকটা সতীন-সম্পর্কের মতো। যেখানে বিজ্ঞানের আলো যত পরিষ্কার, সেখানে কুসংস্কারের কুয়াশা ততখানিই অস্বচ্ছ।
কুসংস্কারের দৃষ্টান্ত : প্রাত্যহিক জীবনে হাজারতর কুসংস্কার রয়েছে। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃকীর্তন’ কাব্যে রয়েছে, রাধা গৃহ থেকে বের হওয়ার সময় হাঁচি উঠেছিল এবং মাথার ওপর দিয়ে টিকটিকি গিয়েছিল বলে তার দিনটা অশুভ গেল। শুধু মধ্যযুগে নয়, আধুনিক জীবনে কৃষি, ধর্ম, যাত্রাপথ বর্ণন ইত্যাদি প্রসঙ্গে কুসংস্কার আছেই। যেমন,
১. শিকারির পক্ষে গো-সাপ দর্শন অশুভ। যেমন, মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ‘আখেটিক’ খণ্ডে কালকেতুর গোসাপ দর্শন।
‘তেরো’ সংখ্যা অশুভ। যদিও রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান।
৩. নির্জন স্থানের মধ্যে গমনকালে ভূতে লাগা, বিশেষ করে বাঁশ ও তাল গাছের সঙ্গে ভূতের সম্পর্ক আছে।
৪. সাপে কাটা মানুষকে ঝাড়-ফুঁক করা ইত্যাদি।
কুসংস্কার দূরীকরণে বিজ্ঞান : কুসংস্কার ব্যক্তির পক্ষে অহিতকর। প্রগতিবিরোধী। মানুষের যুক্তিবোধকে নষ্ট করে কুসংস্কার। কুসংস্কার দূরীকরণে আমাদের কতকগুলি কর্মসূচি নিতে হবে যেমন—অ। যুক্তিনিষ্ঠ হতে হবে, আ। বিজ্ঞানমঞ্চের কর্মসূচি বাড়াতে হবে, ই। ‘Magic power' বা গুপ্তবিদ্যা সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করতে হবে, ঈ। শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে, উ। বিজ্ঞানচেতনার প্রসার ঘটাতে হবে।
সংস্কার ও কুসংস্কার : দ্বন্দ্ব ও পরিণাম : সংস্কার শব্দটি দুটি অর্থ বহন করে—(এক) প্রচলিত আচার, প্রথা, বিশ্বাসের প্রতি নির্ভরতা। (দুই) প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল আন্দোলন এবং নতুন ঐতিহ্য
সৃষ্টি। ‘সংস্কার' শব্দটি যখন প্রথম অর্থে ব্যবহৃত, তখন তা মানুষের বিকৃত চেতনার দুর্বল পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই শব্দটি যখন দ্বিতীয় অর্থে হয় প্রযুক্ত, তখন তা যুক্তি, বুদ্ধি, বিজ্ঞান চেতনার আলোকে সিঞ্চিত হয়ে নতুন প্রজ্ঞার পথে মানবমনকে পরিচালিত করে। দ্বিতীয় পথে বিপ্লব সূচিত হয়। পরিবর্তনের পথে এগিয়ে চলে বন্ধ্যা ও ক্ষয়িষ্ণু সমাজ। সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে মানুষ কুসংস্কারে বন্দী হয়ে অতিপ্রাকৃত জীবনে নির্ভরশীল হয়েছে। আদি-মধ্যযুগের প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্মকীর্তন’-এ এই কুসংস্কারের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘পদ্মাপুরাণ’ কাব্যে (বিজয়গুপ্ত রচিত) রয়েছে বিবিধ অমঙ্গলসূচক চিহ্ন, যা মূলত কুসংস্কারের হাস্যকর পরিণাম। এসব সংস্কারের অন্তরালে জ্ঞানবুদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ জলপড়া খাওয়ানো, মাদুলি ধারণের সঙ্গে বিজ্ঞানের কারণ-কার্য সম্পর্ক নির্ণয় কঠিন কাজ। পাশ্চাত্য দেশেও এমন কুসংস্কার আছে। যেমন তেরো সংখ্যা তাদের কাছে অতীব অশুভ।
কুসংস্কারে বন্দি মানবমন : নগরসভ্যতার বিজ্ঞানপুষ্ট মানুষ যখন কুসংস্কারের শিকার হয়, তখন নগরজীবনের বাইরে শত শত কিলোমিটার দূরের পল্লিজীবন যে সংস্কারের কালো পর্দার মধ্যে বাস করবে এটা স্বাভাবিক। যে ডাক্তার কিংবা বিজ্ঞানী আঙুলে রত্ন ধারণ করে শল্যচিকিৎসা করছেন বা পারমানবিক পরীক্ষা করছেন, তিনিই তো কুসংস্কারের সবচেয়ে বড়ো প্রচারক। তাহলে শুধুমাত্র শিক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়ে কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করা যাবে না। মানুষের অজ্ঞতাই কুসংস্কারের একমাত্র মৃত্যুবীজ নয়, মানুষের দুর্বলতাই কুসংস্কারের প্রধান বন্ধু। সুতরাং আমাদের সিদ্ধান্ত, -
১. দুর্বল দেহ, রোগে আচ্ছন্ন মন ও বলিষ্ঠতার অভাবের কারণে কুসংস্কারের জন্ম হয় ।
২. প্রাচীন বিশ্বাস যা বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্যসূত্রে বাহিত হয়, তা থেকেই কুসংস্কারের জন্ম হয়।
৩. সঠিক ধর্মীয় পথ নয়, ধর্মের সোজা পথে যখন আচার ও নিয়মের শত বাঁক নেয়, তখন কুসংস্কারের দেখা মেলে। বস্তুত, কুসংস্কার মানবমনকে ভারাক্রান্ত করে। সমাজকে পিছনের দিকেটানে। জীবনযাত্রা হয়ে পড়ে অচল ও অসাড়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড় পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।
শেষকথা : কুসংস্কার মানুষকে বিপথগামী করে। আত্মবিশ্বাস, প্রগাঢ় যুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্কতা কুসংস্কার দূরীকরণের একমাত্র পথ।